জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হারিয়েছি করোনার ভয়াল থাবায়। যখন বাবার মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম তখনও পরিবারের বাকি সদস্যরা করোনা পজেটিভ। আম্মার অক্সিজেন লেভেল নেমে যাচ্ছিলো বার বার। রাত একটা বাজে তখন, বাবার মৃতদেহের গাড়ি সমনে পাঠিয়ে দিয়ে আম্মার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের ম্যানেজ করতে গিয়েছিলাম। করোনার ভয়াবহতা বাস্তবে না দেখলে এর ধ্বংসাত্মক রূপ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া কঠিন।
গত কিছুদিন ধরে করোনার সংক্রমণ আবারো বেড়েছে। তার-ই নিরিখে মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যই নিজের পরিবারে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো শেয়ার করা। চাইলে পড়তে পারেন।
জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা পার করেছি। তবুও আলহামদুলিল্লাহ। সময়টা হয়তো এর চেয়েও খারাপ হতে পারতো। ০৯ই মার্চ সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে যখন বাবার শরীরে হালকা জ্বর দেখি, তখনই রাতে মিডফোর্ড থেকে পালস-অক্সিমিটার নিয়ে আসি। বাবা আবার শরীর খারাপ লাগলেও বলতো না কখনো। অনেক সময়েই ডাক্তারের কাছে জোর করে নিয়ে যেতাম মেডিকেল চেক আপ করাতে। রাত সাড়ে দশটার টার দিকে যখন অক্সিমিটার নিয়ে বাসায় আসি, তখন সবার অক্সিজেন ৯৭ এর উপরে থাকলেও বাবার অক্সিজেন লেভেল ৮৭/৮৮ এর মতো। ফুপাতো ভাই ডাক্তার হওয়ায় তখনই তাকে পরামর্শের জন্য ফোন দিলাম। ভাইয়া বললো, অক্সিজেন দিতে হবে, সম্ভব হলে এখনই যাও না হলে সকাল সকাল হসপিটাল নিয়ে যেও। ঐদিন বাবা আর হসপিটাল যেতে না করে নাই। একবার বলাতেই রাজি হয়ে যায়। রাতেই বাসার পাশের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই। বাবা তখনও অনেকটাই স্বাভাবিক। রিক্সা নিয়েই কথা বলতে বলতে চলে যাই। ডিউটি ডাক্তর দেখে বললো উনি তে সুস্থ। বাসায় নিয়ে যান আর কিছু ঔষধ লিখে দেই, এগুলো খাওয়ান। মনে হলো ডাক্তারের অক্সিমিটারটা ঠিকভাবে কাজ করছে না। ওনাকে বললাম বিষয়টা। উনিও পরে দেখলো আমাদের অক্সিমিটারে অক্সিজেন রেজাল্ট কম কিন্তু ওনারটায় বেশি। রাত তখন একটার মত। পরে ডাক্তার বললো আপনাদের কনফিউশন থাকলে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। এতো রাতে অন্য হসপিটালের চেয়ে ঢামেক ই ভালো হবে। ঢাকা মেডিকেলের অক্সিমিটারের রেজাল্টও আমাদের অক্সিমিটারের রেজাল্ট একই আসে। ওনারা তখনই ভর্তির পরামর্শ দেয়। তখন অক্সিজেন লেভেল ৮৭। দশ তারিখ রাত দুইটার দিকে ভর্তি করা হলো। অক্সিজেনে দেওয়ার পর, বাবা পুরোপুরি সুস্থ। ভোরবেলা সব আত্মীয় স্বজন এসে হাজির। দশ তারিখ থেকে তেরো তারিখ বাবার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল। অক্সিজেন লাগানো থাকলেই সবকিছু ঠিকঠাক। এর মধ্যে অবশ্য প্রাইভেট হসপিটালে মুভ করার প্লান করলেও বাবার ইচ্ছায়, ডাক্তারের পরামর্শে আর ঢামেকের সেন্টাল অক্সিজেন সিস্টেমের সুবিধার কথা চিন্তা করে তখন আর যাওয়া হয়নি। তেরো তারিখে কভিড পজেটিভ আসে বাবা-মা দুইজনেরই। রীতিমতো কভিড ইউনিটের বেডে চলে যাই। তের তারিখ রাতে বাবা কিছুটা অসুস্থ অনুভব করলেও চোদ্দ তারিখ সকালে আবার স্বাভাবিক। এই পর্যন্ত একবারেও মনে হয়নি বাবাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলব। ১১টার দিকে হঠাৎ বাবা অসুস্থ অনুভব করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, ডাক্তার দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার জন্য বলে। কিন্তুু তখন ঢামেকে ১৪ করোনা আইসিইউ বেডের একটাও খালি নেই। ৫৫ নম্বর সিরিয়ালে আইসিইউ কল দেওয়া হলো। কিন্তু আল্লাহর রহমতে তখন আইসিইউতে ব্যাবহৃত হাইফ্লো নজেল ক্যানেলা ওয়ার্ডেই ব্যাবস্থা হয়। তখন বেডেই ৭৫লিটার অক্সিজেন পাচ্ছিলেন। একেতো ঢামেকের আইসিইউ পাওয়া যাচ্ছেনা, অন্য দিকে এম্বুলেন্সে করে অন্য প্রাইভেট হসপিটালে নিবো তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারন এম্বুলেন্স মাত্র ১৫লিটার অক্সিজেন দিতে পারবে। ৭৫ লিটার থেকে কমিয়ে ১৫ লিটার অক্সিজেন দিলে তখনই একটা বিপদ হতে পারতো। আল্লাহর রহমতে অবশেষে ডাক্তার সহ আইসিইউ এম্বুলেন্সের ব্যাবস্থা হয়। সন্ধ্যার দিকে ধানমন্ডির সোস্যাল ইসলামি ব্যাংক হসপিটালের আইসিইউতে নিয়ে যাই। আইসিইউতে কর্তব্যরত ডাক্তারের কথাটা ছিলো এমন- আমরা আইসিইউ এর রোগীদের সবসময় ভালো খবর দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু রোগীর যা অবস্থা এ মূহুর্তে কোন ধরনের ভালো খবর দিতে পারছি না। আইসিইউতে ডাক্তাররা সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছে কিন্তু শরীর সাপোর্ট না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত ১৫ই মার্চ বিকেল তিনটার দিকে আল্লাহ উনার কাছেই বাবাকে নিয়ে গেলেন।
১৪ তারিখ ছাড়া অন্য দিন গুলোতে বাবা মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিলো। একদিনের মধ্যে করোনা যে মানুষে এভাবে নিয়ে যেতে পারে, বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন
পরিবার নিয়ে সবসময়ই খুব খুশি ছিলাম। আর বাবা ছিলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বন্ধু। করোনা সনাক্ত হবার পরেও বাবার সাথে তিন-চার জন সবসময় হসপিটালেই ছিলাম। সবসময়ই একটা আতঙ্ক থাকত, এই বুঝি ঘুমের মধ্যে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে যায়, এই বুঝি কিছু একটা প্রয়োজন হয়। . আম্মা, স্ত্রী সবাই এখন সুস্থ। সবসময় হাসিখুশি বাবাকে ছাড়া বাসার মধ্যে একটা শূন্যতা কাজ করে সবসময়। লিখতে গিয়েও চোখ মুছতে হয়েছে অনেকবার। প্রত্যাশা একটাই, আমরা যাতে আরো একটু সচেতন হই। আর কারো বাবা-মাকে যেন না হারাতে হয়। . করোনা যাতে না হয় সেই চেষ্টাই আমাদের সবসময় করতে হবে। কিন্তু কোন কারনে আক্রান্ত হয়ে গেলে যে কাজগুলো করতে পারেনঃ
পালস-অক্সিমিটারে একটু পর পর অক্সিজেন চেক করে দেখতে হবে। ৯৩/৯৪ এর নিচে নামলেই অক্সিজেন দিতে হবে। কাত হয়ে বা উবুর হয়ে ঘুমালে অক্সিজেন বাড়ে। এই প্রাকটিসটা করতে পারেন। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। যদিও কভিড রোগীদের কিছু এন্টিবায়োটিক দেওয়ার কারনে এটা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হোক,,,,,,
সাবেক সভাপতি
বরিশাল ডিভিশনাল স্টুডেন্টস্ অ্যাসোটিয়েশন
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
সিইউডিএস